১৯৭১ সালে সৈয়দপুর শহরে বিপুল সংখ্যক মাড়োয়ারি বাস করতেন। তা ছাড়াও সেখানে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আসা হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করতেন যারা ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের অনেক আগে থেকেই ব্যবসায়িক কারণে বাণিজ্যিক শহর সৈয়দপুরে এসেছিলেন। সৈয়দপুর শহরের মাড়োয়ারিদের মধ্যে অনেকেই সমাজসেবী হিসেবে সৈয়দপুরে জনগণের মধ্যে বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। তাদের মধ্যে মাড়োয়ারি সমাজসেবী তুলসীরাম আগারওয়ালের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯১১ সালে তিনি সৈয়দপুরে মেয়েদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, যার নামকরণ হয় তুলসীরাম বালিকা উচ্চবিদ্যালয়।
১৯৭১ সালের ১৩ জুন সৈয়দপুরের গোলাহাটে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সৈয়দপুরের ৪১৩ জন নিরীহ হিন্দু মাড়োয়ারিকে নির্মমভাবে হত্যা করে। সেদিনের গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী শ্যামলাল আগারওয়ালের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ রাত থেকেই অবাঙালিরা সৈয়দপুরে বাঙালি নিধন করতে থাকে। ২৫ মার্চের পর থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও অবাঙালিরা সৈয়দপুরের বিভিন্ন পাড়া আর মহল্লায় প্রবেশ করে নেতৃস্থানীয় বাঙালিদের নির্বিচারে হত্যা করতে থাকে। শহরের মাড়োয়ারিপট্টির বাসিন্দারা তখন আতক্সেক দিন কাটাচ্ছিলেন। মার্চের শুরু থেকেই সৈয়দপুর শহরের বাঙালি পরিবারগুলো পুরোপুরি অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।
উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকে অবাঙালি অধ্যুষিত সৈয়দপুর শহরে এক প্রকার যুদ্ধ যুদ্ধ অবস্থা বিরাজ করতে থাকে।
১২ এপ্রিল তুলসীরাম আগারওয়াল, যমুনা প্রসাদ কেডিয়া ও রামেশ্বর লাল আগারওয়ালকে বন্দি করে সৈয়দপুরের অন্যান্য বিশিষ্টজনদের সঙ্গে রংপুর সেনানিবাসের অদূরে নিসবেতগঞ্জ বধ্যভ‚মিতে নিয়ে হত্যা করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এই ঘটনার পর মাড়োয়ারিপট্টির বাসিন্দারা আরো আতক্সিকত অবস্থায় দিন কাটাতে থাকেন। অবাঙালিরা তখন মাড়োয়ারিদের বাসায় বাসায় লুটতরাজ চালাতে থাকে।
৫ জুন পাকিস্তান সেনাবাহিনী সৈয়দপুর শহরে মাইকে ঘোষণা দিয়ে বলতে থাকে : ‘শহরের হিন্দু মাড়োয়ারিদের নিরাপদ স্থান ভারতে পৌঁছে দেয়া হবে। তাদের জন্য একটি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ট্রেনটি ১৩ জুন সকালে সৈয়দপুর রেলস্টেশন থেকে চিলাহাটির পথে হলদিবাড়ি পৌঁছাবে।’ এই ঘোষণা শুনে মাড়োয়ারিপট্টির বাসিন্দাদের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসে। আর তাই রজনী সিংহানিয়ার মতো মাড়োয়ারিপট্টির অন্য বাসিন্দারা বাঁচার তাগিদে লুটের পর জিনিসপত্র যা বাকি ছিল সেগুলো নিয়েই ভারত যাওয়ার জন্য গোছগাছ শুরু করেন।
লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির
১৩ জুন সৈয়দপুরের রেলওয়ে কারখানা থেকে ৪টি বগি সংবলিত বিশেষ ট্রেন র্যাকটি সকাল ৮টায় স্টেশনের প্ল্যাটফরমে এসে দাঁড়ায়। নিরাপদে ভারতে পৌঁছার আশ্বাস পেয়ে সৈয়দপুর রেল স্টেশনে জড়ো হন হিন্দু মাড়োয়ারিরা। হিন্দু পরিবারের সদস্যরা গাদাগাদি করে ট্রেনে উঠতে থাকেন। সেদিন মোট ৪৪৩ জন যাত্রী ট্রেনে উঠেছিলেন। ইতোমধ্যে পাকিস্তানি সৈন্যরা ট্রেন থেকে ২০ জন তরুণীকে নামিয়ে নেয়। জানা যায় যে, তাদের মিলিটারি জিপে তুলে সৈয়দপুর সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়।
বিশেষ ট্রেনটি সকাল ১০টায় স্টেশন ছাড়ে। সেই ট্রেনে ছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী তপন কুমার দাশ। মাহতাব বেগের শাহাদতের পর সৈয়দপুর শহরের অধিকাংশ বাসিন্দারা গৃহবন্দি হয়ে পড়েন। ইতোমধ্যে একদিন ঘোষণা দেওয়া হলো যে, সৈয়দপুর শহরে বিমানবন্দর নির্মাণ করা হবে। তপন কুমার দাশ এবং আরো অনেককে বিমানবন্দরের কাজ করার জন্য সেখানে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো। এক সময় ইট বিছানোর কাজ শেষ হয়। বাড়ি ফেরার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এদেশীয় দোসররা অনেকের সঙ্গে তপনকেও বন্দি করে তাদের বাড়ির সব জিনিসপত্র লুট করে এবং বন্দিদের বাসে করে সৈয়দপুর সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের ৭ দিন আটকে রাখা হয়। আরো ৭ দিন পর অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১৩ জুন সকালে তাদের ভারতে পৌঁছে দেয়ার কথা বলে স্টেশনে নিয়ে ৪টি বগিতে তুলে দেয়া হয়।
সেদিন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। ট্রেন ছাড়ার পরই যাত্রীরা নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার আনন্দে বিভোর ছিলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই ট্রেনের সব দরজা ও জানালা দ্রুত বন্ধ করে দেয়া হলো। যাত্রীরা ভয়ে জড়সড়। খুব ধীরে চলছিল ট্রেনটি। এই অবস্থায় ট্রেনটি ২ মাইলের মতো পথ অতিক্রম করে। মানবতার ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতকতার প্রমাণ পাওয়া যায় কিছুক্ষণ পরই। সৈয়দপুর শহরের গোলাহাটের কাছে আসার পরই বিশেষ ট্রেনটি থামিয়ে একটা কম্পার্টমেন্টের দরজা খুলে চকচকে রামদা হাতে কয়েকজন অবাঙালি প্রবেশ করে। একইভাবে সবগুলো কম্পার্টমেন্টে উঠতে থাকে অবাঙালিরা। সন্ত্রস্ত লোকজন বাইরে উঁকি দিয়ে দেখেন ভারী আগ্নেয়াস্ত্র হাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছে। ট্রেনে উঠে অবাঙালিরা যাত্রীদের উদ্দেশে চিৎকার করে বলতে থাকে : ‘মালাউন কা বাচ্চা! তুম লোগো কো মারনে কে লিয়ে সরকার কা কিমতি গোলি কিউ খরচ করু?’ (অর্থাৎ বিধর্মীর বাচ্চা! তোদের মারার জন্য সরকারের মূল্যবান বুলেট কেন খরচ করব?)- বলেই ট্রেনের নিরস্ত্র যাত্রীদের কিছু বোঝার সুযোগ না দিয়েই আচমকা রামদা দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। মুহূর্তেই ট্রেনের বগির ফ্লোর বেয়ে আশপাশের মাটিতে নেমে আসে টাটকা রক্তের ধারা।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই গণহত্যার নাম রাখে ‘অপারেশন খরচাখাতা’। এই অপারেশনে ৪১৩ জন নিরীহ হিন্দু মাড়োয়ারিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পুরুষরা চিৎকার করে তাদের পরিবারের নারী সদস্যদের গায়ের কাপড়ে আগুন লাগাতে উপদেশ দেন।
গণহত্যা চলছিল ট্রেনের পশ্চিম পাশে। সেদিনের গণহত্যা থেকে সৌভাগ্যক্রমে ২১ জন যুবক প্রাণে বেঁচে যান। তারা ট্রেনের জানালা ভেঙে পূর্ব পাশে প্রায় ১০/১৫ ফুট নিচে লাফিয়ে পড়েন। নেমেই তারা বৃষ্টির মধ্যে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে দিনাজপুর হয়ে ভারতে পালিয়ে যান। পিছনে শুনতে পান অসহায় যাত্রীদের করুণ আর্তনাদ।
গোলাহাট এলাকায় ১৩ জুন যারা শহীদ হয়েছিলেন তাদের সবার নাম সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। তাদের মধ্যে মাত্র একজনের নাম জানা যায়। তিনি ছিলেন রংপুর শহরের মুলাটোলের বাসিন্দা চিন্তাহরণ দাশ। এক সময় তিনি রংপুরের বেতপট্টি রোডে অবস্থিত আর কে বণিকের ক্যালটেক্স (CALTEX) কোম্পানিতে চাকরি করতেন। কিন্তু ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সামরিক সরকার ক্যালটেক্স কোম্পানির দায়িত্ব নিয়ে নেয়ার পর তিনি সৈয়দপুরে চলে যান। সেখানে মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী যমুনা প্রসাদ কেডিয়ার ‘খেলারাম জগন্নাথ’ প্রতিষ্ঠানের হিসাবরক্ষক হিসেবে তিনি কাজ করতে থাকেন। তার স্ত্রী, দুই ছেলে (বীরেশ্বর দাশ বীরু ও কালীনাথ দাশ হারু) ও দুই কন্যা (লক্ষ্মী রানি পাল ও পুতুল সেন গুপ্ত) রংপুরেই বাস করতেন। যুদ্ধকালীন রংপুর থেকেই তার পরিবার ভারতে আশ্রয় নেন আর কেডিয়া পরিবারের সঙ্গে তিনি সৈয়দপুরে থেকে যান। ১৩ জুন তিনি এই পরিবারের সঙ্গে ভারত যাওয়ার জন্য ৪৪৩ জনের সহযাত্রী হিসেবে সেই ট্রেনে উঠেছিলেন।
লেখকঃ লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির, বীরপ্রতীক, স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত